পাহাড়ের ঢালে, গায়ে অথবা পাহাড় চূড়ায় সারি সারি শাল, সেগুন, মহুয়া, গজারী, আকাশমনি, ইউকেলিপটাস, মিলজিয়ামসহ আরো নাম না জানা কত শত পাহাড়ি গাছ, বনফুল ও ছায়াঢাকা বিন্যাস যেন বিশাল ক্যানভাসে সুনিপুন শিল্পীর রঙ-তুলির আঁচড়। শিল্পীর এ আঁচড় খুব সহজেই প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যেতে পারে বলেই প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী নারী-পুরুষ, শিশু, বয়োবৃদ্ধসহ সবাই ছুটে আসেন শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনী গারো পাহাড়ের মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে। ভারতের মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে ও বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অরণ্যরাজি আর গারো পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ি নদী ভোগাই, চেল্লাখালি, মৃগী, সোমেশ্বরী, মালিঝি, মহারশীর ঐশ্বরিক প্রাচুর্যস্নাত অববাহিকায় সমৃদ্ধ জনপদ শেরপুর। এ জেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি। লাল মাটির উঁচু পাহাড়। গহীন জঙ্গল, টিলা, মাঝে সমতল। দু’পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছন্দ তুলে পাহাড়ী ঝর্ণার এগিয়ে চলা। পাহাড়, বনানী, ঝরণা, হ্রদ এতসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনী অবকাশ কেন্দ্রে। নিম্নে এর বিভিন্ন অংশের বর্ণনা দেওয়া হলঃ ডাইনোসরঃ উচ্চতা ৩৩ ফুট। নির্মাণ কাল ২০০৬ পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় মোঃ আবু বকর সিদ্দিক, জেলা প্রশাসক, শেরপুর। নির্মাতা ভাস্কর হারুন অর রশীদ খান। এটি একটি বৃহৎ ভাস্কর্য যা দেখে আমরা পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাস জানতে পারি। ড্রাগনঃ এটি একটি স্থাপত্যধর্মী ভাস্কর্য। পৃষ্ঠপোষকতায় জনাব নওফেল মিয়া, জেলা প্রশাসক, শেরপুর। ড্রাগনের মাথা দিয়ে প্রবেশ করে ভিতর দিয়ে বের হয়ে যাওয়া একটা অন্যরকম অনুভূতি । জলপরীঃ ঝিলের পাড়ে নির্মিত জলপরি। দেখে মনে হয় জল থেকে সদ্য উঠে এসে শ্রান্ত ক্লান্ত অবস্থায় বসে আছে। সাদা সিমেন্টে নির্মিত ভাস্কর্যটি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন নওফেল মিয়া, জেলা প্রশাসক, শেরপুর। নির্মাতা ভাস্কর রায়হান ও শীষ । ফোয়ারাঃ গ্রীক ধারায় তৈরী চৌবাচ্চার দুইটি হাঁস এবং পানির খেলা। নির্মাণকাল ২০০৮। পৃষ্ঠপোষকতা ও বাসত্মবায়নে জনাব সামছুন্নাহার বেগম, জেলা প্রশাসক, শেরপুর। এর নির্মাতা ভাস্কর মোঃ হারুন অর রশীদ খান। দন্ডায়মান জিরাফঃ উচ্চতা ২৫ ফুট। নির্মাণকাল ২০০৮। এটি গজনীর অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্য। জেলা প্রশাসক সামছুন্নাহার বেগমের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি নির্মিত হয়। ওয়াচ টাওয়ারঃ সুউচ্চ শীর্ষ পাহাড় চূড়ায় নির্মিত হয়েছে আধুনিক স্থাপত্য রীতিতে ৬৪ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন নয়নকাড়া ‘সাইট ভিউ টাওয়ার’। এ টাওয়ারের চূড়ায় উঠে এলে চারদিকে শুধু দেখা যায় ধূসর, আকাশী ও সবুজের মিতালি। পদ্ম সিড়িঃ এটিও জনাব নওফেল মিয়ার চিমত্মা চেতনা থেকে তৈরী হয়েছিল। সিড়ি বেয়ে আকাশ পানে ওঠা এক অন্যবদ্য সৃষ্টি। রেস্ট হাউস থেকে পাহাড়ের পাদদেশে নামার জন্য আঁকাবাঁকা প্রায় দু’শতাধিক সিঁড়িসহ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ‘পদ্ম সিড়ি’ রয়েছে। ‘পদ্ম সিড়ির পাশেই গজারী বনে কাব্য প্রেমীদের জন্য কবিতাঙ্গনের গাছে গাছে ঝোলানো আছে প্রকৃতিনির্ভর রচিত কবিতা। পাহাড়ের পাদদেশে বর্ষীয়ান বটবৃক্ষের ছায়াতলে শান বাঁধানো বেদীসহ বিশাল চত্ত্বর। যোগাযোগ শেরপুর থেকে আনুমানিক দুরত্ব = 30 কি:মি: বাসভাড়া= 50 টাকা। সিএনজি ভাড়া = 250। আবসন ব্যবস্থা মধুটিলা ইকোপার্ক! সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে সাদা ঝরণারাশি। যেন সবুজ মখমলের গায়ে মুক্তোর ধারা। এর সঙ্গে বৈচিত্র্যময় আদিবাসী জীবনযাপন। শাল, সেগুন পরিবেষ্টিত টিলাময় মধুটিলা ইকোপার্ক আপনার নাগরিক জীবনের অবসরে প্রশান্তি এনে দেবে... পাহাড়ি ঝরনার ঝিরঝির শব্দ আর পাখির কলকাকলি গারো পাহাড়ের আকর্ষণ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ গারো পাহাড়। সবুজ-শ্যামল বন, পাহাড়, টিলা আর ঝরনাবেষ্টিত দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা মধুটিলা। ভ্রমণবিলাসীদের জন্য এক মনোরম স্থান। ভ্রমণকে আরও আনন্দময় করে তুলতে এই অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ব্যাপক আয়োজন। নগরীর যান্ত্রিক সভ্যতা থেকে অনেক দূরে গারো পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নয়নাভিরাম এক শৈল্পিক ভুবন। কোলাহলমুক্ত পরিবেশ আর নির্মল বাতাসের স্বাদ নিতে সেখানে পাহাড়ের টিলাকে অবিকল রেখে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে গড়ে তোলা হয়েছে সুদৃশ্য ভবন। সেখানে পাহাড়ের টিলাকে অবিকল রেখে এখানকার সবুজ প্রকৃতি যেন আপন করে নেয়। শ্যামল বৃক্ষরাজির মাঝ দিয়ে পাকা সড়কপথ যেন সুড়ঙ্গের দিকে ঢুকে যাচ্ছে। সারি সারি শাল, গজারি, সেগুন ও লতাগুল্মের বিন্যাস প্রকৃতিপ্রেমীদের দোলা দিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড়ের সমশ্চুড়া ইকোপার্কের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণবিলাসীরা বারবার ছুটে আসেন এখানে। পড়ন্ত বিকেলে এখানকার পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতের তোড়া পাহাড়কে দেখা যায়। মনে হবে ওই তোড়া পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মনের মাঝে জাল বুনবে, হায় জন্ম যদি হতো এই গারো পাহাড়ে। তাই তো আবারও গারো পাহাড়ের মধুটিলা ইকোপার্কে আসার জন্য মন আকুলি-ব্যাকুলি করবে। ফি বছর শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভ্রমণবিলাসীদের ঢল নামে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বন বিভাগের জমিতে এ ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়। কীভাবে যাবেন :ঢাকা থেকে নিজস্ব বাহনে শেরপুর আসতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা। আবার শেরপুর থেকে মধুটিলা ইকোপার্কের দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। ঢাকার মহাখালী টার্মিনাল থেকে ড্রিমল্যান্ড বাসে শেরপুর আসা যায়। ভাড়া ১৯০ টাকা। এখান থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় সাদিকা গেটলক বাস ছাড়ে। দুপুর দেড়টায় ছাড়ে এসি বাস। এসি বাসের ভাড়া ২২০ টাকা। ভুল করে স্পেশাল ড্রিমল্যান্ড ছাড়া অন্য গাড়িতে উঠবেন না। এসব ছাড়া অন্য বাসগুলো লোকাল। এসব বাসে সময়ও লাগে বেশি, ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। শেরপুর নবীনগর বাসস্ট্যান্ডে নেমে সিএনজি নিয়ে সোজা চলে যেতে পারেন ইকোপার্কে। ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আবার নিউমার্কেট অথবা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে থেকে মাইক্রোবাস পাওয়া যায়। ভাড়া ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। আর বাসে শেরপুর থেকে ইকোপার্ক পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা। কী কী দেখবেন : প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি দেখতে পাবেন আদিবাসী গারো, হাজং, কোচ, হদি বর্মণ সম্প্র্রদায়ের অধিবাসীদের। গারো পাহাড়ের গজারি বনের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তায় গাড়ি চালানোর রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো আপনি উপভোগ করতে পারেন। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তার তো কোনো অবকাশই নেই বরং মনকে প্রফুল্ল রাখতে আছে টাটকা খাবারের সুব্যবস্থা। মধুটিলা ইকোপার্কে ঢুকতে প্রবেশ মূল্য দু'জন যাত্রীসহ মোটরসাইকেল ২০, বড় বাস ৫০০, মিনিবাস ২০০ ও লোকাল বাস ৪৫০ টাকা। ইকোপার্কের গেট পার হলেই চোখে পড়বে দু'পাশে গাছের সারির মাঝ দিয়ে রাস্তা। মনে হবে নিচের দিকে ঢুকে যাচ্ছি। আবার ওপরে উঠতেই দু'পাশে দণ্ডায়মান দুটি হাতি আপনাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। আরেকটু এগোলে দেখবেন সাপ, বানর, পাখি আপনাকে সালাম দিচ্ছে। এখানে লেখা রয়েছে আমাকে মারবেন না, আমি বনের অলঙ্কার। সামনে এগোলেই মিনি চিড়িয়াখানা। তারপর কৃত্রিম লেক। লেকে প্যাডেল বোট চলছে। প্রতি প্যাডেল বোটে ৫-৬ জন বসা যায়। ৩০ মিনিট চালাতে ভাড়া ৫০ টাকা। বাঁয়ে ১০০ গজ এগিয়ে গেলে ৫৫ ফুট উঁচু টাওয়ার। টাওয়ারে ওঠার টিকিট ৫ টাকা। এখানে দাঁড়িয়ে খালি চোখে আবছা আবছা ভারতের বিএসএফ ক্যাম্প দেখা যায়। আবার পরিষ্কারভাবে দেখতে চাইলে টাওয়ারে বাইনোকুলার রয়েছে। আপনি টাওয়ারে উঠতেই ডাক শুনবেন, স্যার ভারতের ক্যাম্প দেখবেন! দূরবিন হাতে দিয়েই বলবে, দেখুন স্যার কী পরিষ্কার ভারতের ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। আরও জানাবে, দেখেন ক্যাম্পে ২টি পতাকা উড়ছে না স্যার। একটা পতাকা লাল আর একটা সাদা। দূরবিনে ভারতের ক্যাম্প দেখতে ৫ টাকা লাগে। টাওয়ার থেকে ডানদিকে এগোলে উঁচু পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়িটি এত খাড়া যে, এটাতে কেউ একবার উঠলে বসে একটু বিশ্রাম না নিলে হাঁফিয়ে উঠতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়বে অত্যাধুনিক বন বিভাগের রেস্ট হাউস। এ রেস্ট হাউস থেকে নেমে আসার পথে চোখে পড়বে শিশুদের জন্য শিশুপার্ক। রেস্ট হাউসে প্রতি রুমের ভাড়া ৫০০ টাকা। তবে এখানে রাত কাটানো নিরাপদ নয়। ফিরে আসুন শেরপুরে। | |