সাংবাদিক বজলুর রহমান
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একজন অন্যতম পুরোধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান। বজলুর রহমান সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে অপরিমেয় মেধা ও সৃজনশীলতার অধিকারী ছিলেন। তিনি সাংবাদিকতার আদর্শের প্রতি সত্যনিষ্ঠ ছিলেন যেমন তেমনি জীবনের সত্য, সুন্দর ও মার্জিত বৈশিষ্ট্যগুলোও তার কর্মপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। নিজস্ব আদর্শকে সবার উর্ধ্বে স্থান দিলেও তিনি মেধা, জ্ঞান ও যুক্তির মাধ্যমেই সবকিছু বিবেচনা করতেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, '৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, এবং '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপোসীন সংগ্রামী।
বজলুর রহমান তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে সংবাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বাসস, প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রেস কাউন্সিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বজলুর রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ৩ আগস্ট। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার চরনিয়ামতপুর গ্রামে। তিনি ১৯৬১ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংবাদে যোগদান করেন। কিছুদিন পর তিনি সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। আমৃত্যু তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকে কিছুদিন কাজ করেছেন।
আজ থেকে ২৩ বছর আগে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ-এ 'হালচাল' কলামে বজলুর রহমান লিখেছিলেন, 'কৃষিখাতে ঋণ যে দেয়া হচ্ছে না বা খুব কম দেয়া হচ্ছে, তা নয়। স্বাধীনতার পর ঋণের অঙ্কের চেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল সস্তার নামে উপকরণ সরবরাহের প্রতি। ভর্তুকি দিয়ে বীজ, সার, সেচযন্ত্র ও কীটনাশক দেয়া হতো কৃষকদের। এক ধরনের সমবায় গড়ে উঠেছিল সেচযন্ত্রগুলোকে কেন্দ্র করে। তারপর বিদেশী সাহায্যদাতাদের পরামর্শে ভর্তুকি ক্রমে তুলে নেয়া হলো। বর্ধিত উপকরণ ব্যয় মেটানোর জন্য জোর দেয়া হলো ঋণের ওপর। গত এক দশকে বিপুল অঙ্কের কৃষিঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর সুবিধা ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা পেয়েছে কমই। ঋণের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে গেছে গ্রামের প্রভাব প্রতিপত্তিশালীরা। তার চেয়ে বড় কথা ঋণের টাকা কৃষিতে ঠিকভাবে বিনিয়োজিত হয়নি। গরিবরা যদি আকালের মৌসুমে ঋণের টাকা ভেঙে পেটের ভাত জুগিয়ে থাকে তো বড় জোতদাররা এ টাকায় মোটরসাইকেল-টিভি কিনেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুতদারিতে খাটিয়েছে, এমন কি গরিব চাষির জমি বন্ধক বা কিনে নিয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন যতটা বাড়তে পারত, তা হয়নি, ঋণের টাকা আদায়েও সৃষ্টি হয়েছে বিরাট সমস্যা।'
'এদেশে কৃষি ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ দিয়েছে সরকারি হুকুমে। হুকুম হলো, এত তারিখের মতো এতশ' কোটি টাকা ঋণ দিতে হবে। ব্যাংকগুলো সময়সীমা সঠিক রাখার জন্য যাকে পেয়েছে তাকেই ঋণ দিয়েছে। এর ওপর রয়েছে ব্যাংককর্মীদের দুর্নীতি। ফলে সঠিক লোক ঋণ পায়নি। ঋণ আদায়ের বেলায়ও সরকারি হুকুমের জবরদস্তি। খরা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল মার খাওয়ার দিকে খেয়াল করা হয়নি। এত তারিখের মধ্যে ঋণ আদায় করতে হবে। সুতরাং কৃষকের গরু, ছাগল, ঘটিবাটি চড়াও নিলামে। বডি ওয়ারেন্ট জারি করে পোরো হাজতে। এতে ভয়ে সাধারণ মানুষ তওবা করেছে আর কোন দিন ব্যাংকমুখো হবে না। যাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, ঋণ আদায়ের ব্যাপারে তাদের কোন দায়িত্ব রইল না। তাদের সহযোগিতাও পেলেন না ব্যাংককর্মীরা। ফলে বিপুল অঙ্কের কৃষিঋণ অনাদায়ী পড়ে রইল। ঋণের উৎস গেল শুকিয়ে। ঋণ আদায় করা হয়েছে যত, পরবর্তীতে ঋণ দেয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। স্বভাবতই ঋণ আদায়ের কড়াকড়ির প্রথম ও মুখ্য শিকার প্রান্তিক কৃষক। নয়া ঋণদান সঙ্কোচনের শিকারও তারাই।'
“আমার সম্পাদক বজলুর রহমান” শীরোনামে এক কলামে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছেন, “১৯৭০ সালের জুলাই মাসে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকা বের হয়। তখনকার গোপন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি একতার সম্পাদক হিসেবে বজলুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। আমি তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছি। ওই সময় সাংবাদিকতা বিষয়ে আমার কোনো শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর উত্তাল দিনগুলোতে আমরা বজলু ভাইয়ের নেতৃত্বে একতা বের করছিলাম মহাউৎসাহ-উদ্দীপনায়। সেই এক রোমাঞ্চকর সময় কেটেছে একতাকে কেন্দ্র করে। তখনই বজলু ভাইয়ের কাছে আমার সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ; অভিজ্ঞতার শুরু। অবশ্য বজলুর রহমানকে আমি ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে চিনি। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে দৈনিক সংবাদ-এ কাজ শুরু করেছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়ন ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অতি ঘনিষ্ঠজন। সভা-সমাবেশে, মিছিলে তাঁকে দেখেছি। তবে অর্থনীতির ছাত্র বজলুর রহমান পাস করে বের হওয়ার পর ধীরে ধীরে সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে পড়েন। ষাটের দশকজুড়ে একই সঙ্গে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও আফ্রো-এশীয় গণসংহতি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
বজলু ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের নেত্রী ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মতিয়া চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসার কথা সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে জানতাম। মতিয়া আপার বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মতিয়া আপার সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির কারণে অভিভাবক হিসেবে তাঁর বাবার ওপর সরকারের চাপ ছিল। ওই অবস্থায় বাবাকে সরকারের চাপ থেকে মুক্ত করতে মতিয়া আপা দ্রুত অভিভাবকত্ব পরিবর্তন, অর্থাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৪ সালে বজলু ভাই আর মতিয়া আপার বিয়ে হয়েছিল পুরান ঢাকার ৩ নম্বর কাজী আবদুল হামিদ লেনের বাসায়। বিয়ের পর সংসার পেতেছিলেন বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ সুলতানের শেখ সাহেব বাজারের বাড়িতে। তারপর বেশ কয়েক বছর ছিলেন শান্তিনগরের এক বাসায়।
ষাটের দশকজুড়েই বজলু ভাইকে একজন বলিষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতির নেপথ্য সংগঠক হিসেবে দেখেছি। অন্যদিকে ওই সময়ের অনলবর্ষী বক্তা আমাদের নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ধীরে ধীরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ-নেত্রী হিসেবে সারা দেশে ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি পান। দারুণ বক্তৃতা করেন। তখনই তিনি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’। সেই দিনগুলোতে বারবার তাঁকে যেতে হয়েছিল কারাগারে। স্বাধীনতার পর সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছেন সংবাদ-এ। পরে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বই হয়ে বেরিয়েছিল। তখন তিনি সংবাদ-এর মহিলা পাতার দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭৪ সালে আমি একতার সম্পাদকের দায়িত্ব নেই। পঁচাত্তরের পর দেশের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হতে থাকে। তখন বামপন্থীদের মধ্যেও নানা বিতর্ক দেখা দেয়। আমাদের মধ্যেও এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সত্তর ও আশির দশকে দেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি। বজলু ভাই আর মতিয়া আপার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানে পার্থক্য দেখা দেয়, তবুও আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অব্যাহত থাকে। গণতন্ত্র আর প্রগতির মিছিলে আমরা চলি।
বহুদিন পর ১৯৮৮ সালে আবার নতুন করে সাংবাদিকতার দীক্ষা নিতে ও সহযোগিতা পেতে আমি বজলু ভাইয়ের শরণাপন্ন হই। তখন বাংলাদেশসহ সর্বত্র সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে ভাঙাগড়া চলছে। সে সময় টানা তিন বছর তাঁর নিবিড় পরিচর্যায় আমি সংবাদে রাজনৈতিক কলাম লিখেছি। প্রতি সোমবার আমার লেখা বের হতো। লেখা নিয়ে শনিবার দুপুরের পর আমার সম্পাদক বজলুর রহমানের টেবিলে উপস্থিত হতাম। তিনি ভালোভাবে দেখে, পরামর্শ দিয়ে, প্রয়োজনীয় কাটাকুটি করে লেখাকে আরও সমৃদ্ধ করতেন। সে সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হয়েছে বজলু ভাইয়ের সঙ্গে। তখন তিনি সংবাদে রিপোর্ট করার কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমাকে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভোরের কাগজ এবং পরে প্রথম আলো নিয়ে যাত্রা শুরু করার সময়ও আমরা বজলুর রহমানের শুভেচ্ছা পাই। আমাদের জীবন সংগ্রামের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বজলু ভাই আর মতিয়া আপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অব্যাহত ছিল। ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনে মতিয়া আপা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হলে আমরা তাঁর সঙ্গে ছিলাম। যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
আমরা আমাদের ষাটের দশকের সহযাত্রীদের মধ্যে সব সময় গভীর একাত্মতা বোধ করি। বজলু ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই, তবুও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। একই সঙ্গে আমরা মতিয়া আপাকেও বলব, অতীতের মতো আগামী দিনগুলোতেও আমরা আপনার পাশে থাকব।“ (প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৮)।