উপরে যান

বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১১

সাংবাদিক বজলুর রহমান


 সাংবাদিক বজলুর রহমান

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একজন অন্যতম পুরোধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান। বজলুর রহমান সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে অপরিমেয় মেধা ও সৃজনশীলতার অধিকারী ছিলেনতিনি সাংবাদিকতার আদর্শের প্রতি সত্যনিষ্ঠ ছিলেন যেমন তেমনি জীবনের সত্য, সুন্দর ও মার্জিত বৈশিষ্ট্যগুলোও তার কর্মপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেননিজস্ব আদর্শকে সবার উর্ধ্বে স্থান দিলেও তিনি মেধা, জ্ঞান ও যুক্তির মাধ্যমেই সবকিছু বিবেচনা করতেন
মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, '৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, এবং '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপোসীন সংগ্রামী।
বজলুর রহমান তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে সংবাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বাসস, প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রেস কাউন্সিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন
বজলুর রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ৩ আগস্ট।  ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার চরনিয়ামতপুর গ্রামেতিনি ১৯৬১ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংবাদে যোগদান করেন। কিছুদিন পর তিনি সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেনআমৃত্যু তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেনএ ছাড়া তিনি সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ছিলেনদৈনিক ইত্তেফাকে কিছুদিন কাজ করেছেন
আজ থেকে ২৩ বছর আগে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ-'হালচাল' কলামে বজলুর রহমান লিখেছিলেন, 'কৃষিখাতে ঋণ যে দেয়া হচ্ছে না বা খুব কম দেয়া হচ্ছে, তা নয়স্বাধীনতার পর ঋণের অঙ্কের চেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল সস্তার নামে উপকরণ সরবরাহের প্রতিভর্তুকি দিয়ে বীজ, সার, সেচযন্ত্র ও কীটনাশক দেয়া হতো কৃষকদেরএক ধরনের সমবায় গড়ে উঠেছিল সেচযন্ত্রগুলোকে কেন্দ্র করেতারপর বিদেশী সাহায্যদাতাদের পরামর্শে ভর্তুকি ক্রমে তুলে নেয়া হলোবর্ধিত উপকরণ ব্যয় মেটানোর জন্য জোর দেয়া হলো ঋণের ওপরগত এক দশকে বিপুল অঙ্কের কৃষিঋণ দেয়া হয়েছেকিন্তু এর সুবিধা ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা পেয়েছে কমইঋণের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে গেছে গ্রামের প্রভাব প্রতিপত্তিশালীরাতার চেয়ে বড় কথা ঋণের টাকা কৃষিতে ঠিকভাবে বিনিয়োজিত হয়নিগরিবরা যদি আকালের মৌসুমে ঋণের টাকা ভেঙে পেটের ভাত জুগিয়ে থাকে তো বড় জোতদাররা এ টাকায় মোটরসাইকেল-টিভি কিনেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুতদারিতে খাটিয়েছে, এমন কি গরিব চাষির জমি বন্ধক বা কিনে নিয়েছেফলে কৃষি উপাদন যতটা বাড়তে পারত, তা হয়নি, ঋণের টাকা আদায়েও সৃষ্টি হয়েছে বিরাট সমস্যা'
'এদেশে কৃষি ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ দিয়েছে সরকারি হুকুমেহুকুম হলো, এত তারিখের মতো এতশ' কোটি টাকা ঋণ দিতে হবেব্যাংকগুলো সময়সীমা সঠিক রাখার জন্য যাকে পেয়েছে তাকেই ঋণ দিয়েছেএর ওপর রয়েছে ব্যাংককর্মীদের দুর্নীতিফলে সঠিক লোক ঋণ পায়নিঋণ আদায়ের বেলায়ও সরকারি হুকুমের জবরদস্তিখরা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল মার খাওয়ার দিকে খেয়াল করা হয়নিএত তারিখের মধ্যে ঋণ আদায় করতে হবেসুতরাং কৃষকের গরু, ছাগল, ঘটিবাটি চড়াও নিলামেবডি ওয়ারেন্ট জারি করে পোরো হাজতেএতে ভয়ে সাধারণ মানুষ তওবা করেছে আর কোন দিন ব্যাংকমুখো হবে নাযাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, ঋণ আদায়ের ব্যাপারে তাদের কোন দায়িত্ব রইল নাতাদের সহযোগিতাও পেলেন না ব্যাংককর্মীরাফলে বিপুল অঙ্কের কৃষিঋণ অনাদায়ী পড়ে রইলঋণের উস গেল শুকিয়েঋণ আদায় করা হয়েছে যত, পরবর্তীতে ঋণ দেয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক কমস্বভাবতই ঋণ আদায়ের কড়াকড়ির প্রথম ও মুখ্য শিকার প্রান্তিক কৃষকনয়া ঋণদান সঙ্কোচনের শিকারও তারাই'
আমার সম্পাদক বজলুর রহমান” শীরোনামে এক কলামে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছেন, “১৯৭০ সালের জুলাই মাসে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকা বের হয়তখনকার গোপন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি একতার সম্পাদক হিসেবে বজলুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলআমি তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছিওই সময় সাংবাদিকতা বিষয়ে আমার কোনো শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছিল নাঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর উত্তাল দিনগুলোতে আমরা বজলু ভাইয়ের নেতৃত্বে একতা বের করছিলাম মহাউসাহ-উদ্দীপনায়সেই এক রোমাঞ্চকর সময় কেটেছে একতাকে কেন্দ্র করেতখনই বজলু ভাইয়ের কাছে আমার সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ; অভিজ্ঞতার শুরুঅবশ্য বজলুর রহমানকে আমি ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে চিনিতখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে দৈনিক সংবাদ-এ কাজ শুরু করেছেনতিনি ছিলেন তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়ন ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অতি ঘনিষ্ঠজনসভা-সমাবেশে, মিছিলে তাঁকে দেখেছিতবে অর্থনীতির ছাত্র বজলুর রহমান পাস করে বের হওয়ার পর ধীরে ধীরে সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে পড়েনষাটের দশকজুড়ে একই সঙ্গে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও আফ্রো-এশীয় গণসংহতি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন
বজলু ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের নেত্রী ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মতিয়া চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসার কথা সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে জানতামমতিয়া আপার বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তামতিয়া আপার সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির কারণে অভিভাবক হিসেবে তাঁর বাবার ওপর সরকারের চাপ ছিলওই অবস্থায় বাবাকে সরকারের চাপ থেকে মুক্ত করতে মতিয়া আপা দ্রুত অভিভাবকত্ব পরিবর্তন, অর্থা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন১৯৬৪ সালে বজলু ভাই আর মতিয়া আপার বিয়ে হয়েছিল পুরান ঢাকার ৩ নম্বর কাজী আবদুল হামিদ লেনের বাসায়বিয়ের পর সংসার পেতেছিলেন বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ সুলতানের শেখ সাহেব বাজারের বাড়িতেতারপর বেশ কয়েক বছর ছিলেন শান্তিনগরের এক বাসায়
ষাটের দশকজুড়েই বজলু ভাইকে একজন বলিষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতির নেপথ্য সংগঠক হিসেবে দেখেছিঅন্যদিকে ওই সময়ের অনলবর্ষী বক্তা আমাদের নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ধীরে ধীরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ-নেত্রী হিসেবে সারা দেশে ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি পানদারুণ বক্তৃতা করেনতখনই তিনি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’সেই দিনগুলোতে বারবার তাঁকে যেতে হয়েছিল কারাগারেস্বাধীনতার পর সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছেন সংবাদ-পরে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বই হয়ে বেরিয়েছিলতখন তিনি সংবাদ-এর মহিলা পাতার দায়িত্বে ছিলেন
১৯৭৪ সালে আমি একতার সম্পাদকের দায়িত্ব নেইপঁচাত্তরের পর দেশের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হতে থাকেতখন বামপন্থীদের মধ্যেও নানা বিতর্ক দেখা দেয়আমাদের মধ্যেও এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়সত্তর ও আশির দশকে দেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলিবজলু ভাই আর মতিয়া আপার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানে পার্থক্য দেখা দেয়, তবুও আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অব্যাহত থাকেগণতন্ত্র আর প্রগতির মিছিলে আমরা চলি
বহুদিন পর ১৯৮৮ সালে আবার নতুন করে সাংবাদিকতার দীক্ষা নিতে ও সহযোগিতা পেতে আমি বজলু ভাইয়ের শরণাপন্ন হইতখন বাংলাদেশসহ সর্বত্র সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে ভাঙাগড়া চলছেসে সময় টানা তিন বছর তাঁর নিবিড় পরিচর্যায় আমি সংবাদে রাজনৈতিক কলাম লিখেছিপ্রতি সোমবার আমার লেখা বের হতোলেখা নিয়ে শনিবার দুপুরের পর আমার সম্পাদক বজলুর রহমানের টেবিলে উপস্থিত হতামতিনি ভালোভাবে দেখে, পরামর্শ দিয়ে, প্রয়োজনীয় কাটাকুটি করে লেখাকে আরও সমৃদ্ধ করতেনসে সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হয়েছে বজলু ভাইয়ের সঙ্গেতখন তিনি সংবাদে রিপোর্ট করার কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমাকে
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভোরের কাগজ এবং পরে প্রথম আলো নিয়ে যাত্রা শুরু করার সময়ও আমরা বজলুর রহমানের শুভেচ্ছা পাইআমাদের জীবন সংগ্রামের চড়াই-রাই পেরিয়ে বজলু ভাই আর মতিয়া আপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অব্যাহত ছিল’৯১, ’৯৬ ও ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনে মতিয়া আপা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হলে আমরা তাঁর সঙ্গে ছিলামযথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করেছি
আমরা আমাদের ষাটের দশকের সহযাত্রীদের মধ্যে সব সময় গভীর একাত্মতা বোধ করিবজলু ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেনতিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই, তবুও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেনএকই সঙ্গে আমরা মতিয়া আপাকেও বলব, অতীতের মতো আগামী দিনগুলোতেও আমরা আপনার পাশে থাকব(প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৮)